চালকবিহীন গাড়ি; স্বপ্ন নয় সত্যি।

974

শিরোনাম দেখে হয়তো অনেকে চমকে গিয়েছেন। বলিউডপ্রেমীরা হয়তো এতক্ষণে সিদ্ধান্তে পৌছে গিয়েছেন। একটা দীর্ঘ হামি দিয়ে বলে ফেললেন ও, আয়েশা টাকিয়া অভিনীত Taarzan: The Wonder Car এর কথা বলছেন! হ্যাঁ, আপনি একদম ঠিকই ধরেছেন। আমরা সেই মালিক হত্যার প্রতিশোধ নেয়া টারজানের কথাই বলছি। তবে এই সাইটের সাথে পরিচিতরা কিংবা এই সাইটের নাম দেখে নিশ্চইয় বুঝতে পেরেছেন এটা সিনেমার কথা বলার প্লাটফর্ম না। তাহলে!
সমজদারদের জন্য যেমন ইশারাই যথেষ্ট, ঠিক তেমনি অনেকেই নিশ্চইয় বুঝতে পেরেছেন আমরা চালকবিহীন গাড়ির কথা বলছি। তবে টারজানের মতো রাত বিরাতে গর্জে উঠা সিনেম্যাটিক নয়। একেবারে সত্যি সত্যি! তাই আমাদের আজকের ফিচার বিস্ময়কর এই চালকবিহীন গাড়িকে নিয়েই।

বাড়ি থেকে বেরুলেন অফিসের উদ্দেশে। আপনার চালক অনুপস্থিত। গাড়িটিই আপনাকে পৌঁছে দিল গন্তব্যে। এমনটা হলে কেমন লাগবে ভাবুন তো? 'চালকবিহীন গাড়ি' কল্পবিজ্ঞানের বস্তু বলে মনে হলেও, বাস্তবে এর কাজ অনেকটাই এগিয়েছে। চলছে পরীক্ষামূলক ব্যবহার। আর এই প্রজেক্ট 'গুগল কার' নিয়ে মাঠে নেমেছে গুগল। সহযোগিতায় রয়েছে টয়োটা।

গাড়ির ড্যাশবোর্ডে বোতাম টিপে গন্তব্য ঠিক করে দিলে এই গাড়িটিই পৌঁছে দেবে গন্তব্যে। কীভাবে? সেটাই তো এই গাড়ির অন্যতম রহস্য। গাড়ির ওপরে লাগানো থাকে একটি জাঁদরেল ক্যামেরা-সেন্সর। ৩৬০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে ৬৪বিম লেসার নজরদারি চালাবে। সামনের গাড়িটি কত স্পিডে চলছে, রাস্তায় হঠাৎ কোন সুন্দরি-ভিআইপি অথবা কোন বৃদ্ধ চলে এলো কি-না, কোথায় বাঁক রয়েছে, কোথায় ডেড এন্ড - এ সবই গাড়ির যন্ত্রমস্তিষ্কে থ্রিডি ইমেজ হিসেবে স্টোর হতে থাকবে। গাড়ির চাকাতেও থাকবে হুইল মোশন সেন্সর। আর থাকবে জিপিএস। এই সব ক'টি মিলিয়ে চলবে গুগল কার। গাড়ির মেমোরিতে থাকবে ট্রাফিক লাইটের কোনটার মানে কী, কোন রোড সাইনে কী করা উচিত, সে সব।

তো কথা হচ্ছে কি এমন আছে এই গাড়িতে যে এটার এত গুণ! এতসব কাজ কিভাবে গাড়িটি সম্পন্ন করে। আসুন তাহলে জেনে নিই কিভাবে চালকবিহীন গাড়ি কাজ করে। বিস্তারিত লেখার প্রয়োজন মনে করছি না। নিচের ছবিটি ভালোভাবে লক্ষ্য করলেই আশা করি বিষয়টি বুঝতে তেমন কোন সমস্যা হবে না। ছবিটি দৈনিক প্রথম আলো থেকে নেয়া হয়েছে।

চালকবিহীন গাড়ি যেভাবে চলে

 

এবার চলুন এই বিস্ময়কয় আবিষ্কারের শুরু থেকে শেষটা জেনে নিই,

মোটামুটি বেশ লম্বা সময় ধরেই টেক জায়ান্ট গুগল ক্যালিফোর্নিয়ার পাহাড়ি অঞ্চলে নিজেদের প্রধান কার্যালয়ের কাছে চালকবিহীন গাড়ির পরীক্ষা চালাচ্ছে। গুগল দাবী করে আসছে আগামী ২০২০ সালের মধ্যেই চালকবিহীন গাড়ি অভিনব জনপ্রিয়তা অর্জন করবে। অন্যদিকে টেক পাড়ায় গুঞ্জন চলছে প্রযুক্তি পণ্য নির্মাতা অ্যাপল ও চালকবিহীন গাড়ি নির্মাণে যুক্ত হচ্ছে। এ্যাপলের পক্ষ থেকে গাড়ি নিবন্ধিত করা হয়েছে। কয়েকটি ক্যামেরা নিয়ে গাড়ির পরীক্ষাও চালানো হচ্ছে। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর চেয়ে নিজের দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে যুক্তরাজ্য। এরই মধ্যে চালকবিহীন গাড়ি উৎপাদন বাড়াতে সরকার এক কোটি ৯০ লাখ পাউন্ড বিনিয়োগ করেছে।

জার্মানিতে চালিত চালকবিহীন গাড়ি

সব নতুন প্রযুক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠলে কয়েকদিন তা নিয়ে বেশ শোরগোল থাকে। কিন্তু পরে এটার ভালো-খারাপ, সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে টেকপাড়া থেকে শুরু করে সোশ্যাল সাইটগুলোতেও চলে ব্যাপক সমালোচনা। তো কথা হচ্ছে স্বয়ংচালিত গাড়ির সুবিধা হলো, সাধারণ পরিস্থিতিতে তার জুড়ি নেই। কিন্তু পরিস্থিতি হঠাৎ বিগড়োলে সামাল দিতে পারবে তো এই গাড়ি। অবশ্য এই নিয়ে বিস্তর গবেষণা ইতেমধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছে। আমরা বিস্তারিত পরে ধারাবাহিকভাবে আলোচনা করবো। মানুষ্যচালিত গাড়ির মতো হতে হলে এই গাড়িকে দিতে হবে মানবিক কিছু বৈশিষ্ট্য। সেই লক্ষ্যে এখন অব্দি মোটামুটিভাবে পনেরো লাখ ইউরোর বেশি পয়সা খরচ করে ফেলেছে গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটি। মানবিক বৈশিষ্ট অর্জনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিলো গাড়িটি আশেপাশের অবস্থা বিবেচনা করবে কিভাবে। এই কিভাবের উত্তর দিয়েছিলেন আইটি বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডক্টর রাউল রখাস। তিনি বলেছেন,

‘স্বয়ংক্রিয় গাড়ি চালনার সবচেয়ে মুশকিল ব্যাপার রাস্তা চেনা বা নেভিগেশন নয়, সে তো আজকালকার সাধারণ গাড়িগুলোও পারে। মুশকিল হলো ট্রাফিক লাইট, ট্রাফিক সাইন আর পথচারীদের চেনা, বিশেষ করে রাস্তায় মানুষজন কোথায় দাঁড়িয়ে, গাড়িকে সেটা জানতে হবে, তার খেয়াল রাখতে হবে।’

জার্মানি হচ্ছে ইউরোপের গাড়ি তৈরির আঁতুড়ঘর। এখানেই পরীক্ষা করে দেখা হয়, গাড়ি চালানোর সময় মানুষের কি ধরনের প্রতিক্রিয়া হয় তা সে সাধারণ পরিস্থিতিতেই হোক, আর বিপজ্জনক পরিস্থিতিতেই হোক। কম্পিউটারে সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা দেখেন, মানুষের তথাকথিত সপ্তম ইন্দ্রীয় কিভাবে কাজ করে। প্রযুক্তিবিদদের স্বপ্ন হলো এমন একটি বুদ্ধিমান গাড়ি, যা সাধারণ গাড়ি চালকদের চেয়ে বেশি যুক্তভাবে কাজ করবে। অনেকটা সময় ধরে এসব বিষয় নিয়ে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করছেন, এবং মোটামুটি সব ধরনের সম্ভাব্যতার কথা চিন্তা করেই বিজ্ঞানীরা গাড়ির ডিজাইন করে থাকেন। জার্মানির বিখ্যাত গাড়ির ডিজাইনার প্রফেসর লেমার বলেন,

‘স্বয়ংচালিত গাড়ির রহস্য হলো, গাড়িটা ঠিক একজন মানুষের মতো তার পারিপার্শ্বিকের খোঁজখবর রাখতে পারবে। সেজন্য দরকার এমন সব সেন্সর, যেগুলো বিভিন্ন ধরনের আলো, বিভিন্ন ধরনের আবহাওয়ায় কাজ করবে। তাছাড়া ওই গাড়ির একজন গাড়িচালকের মতো অভিজ্ঞতা থাকা চাই- সামনে হয়ত কেউ সিগনাল না দিয়েই মোড় নিচ্ছে। এই তথ্যটিকে প্রযুক্তিগতভাবে সংগ্রহ করে সেই অনুযায়ী কাজ করা, যাতে কোন বিপদ না ঘটে, এটাই হলো স্বয়ংক্রিয় গাড়ি চালানোর মূল বিষয়।’

যুক্তরাজ্যের চারটি এলাকায় ইতোমধ্যে চালু হয়েছে চালকবিহীন গাড়ি। দেশটির পরিবহন চলাচলের আইনে একটি প্রস্তাবের কারণেই জনগণ এই পরীক্ষামূলক চালকবিহীন গাড়ির যাত্রী হতে পারবেন। লন্ডনের গ্রিনিচে যুক্তরাজ্যের মন্ত্রীরা উপস্থিত থেকে পরীক্ষামূলক চালকবিহীন গাড়ি চলাচলের উদ্বোধন করার কথা। একই সঙ্গে চালকবিহীন গাড়ি চালু হবে বাকিংহ্যামশায়ার, মিল্টন কেইনেস ও কভেন্ট্রিতে। এর আগে যুক্তরাজ্যে চালকবিহীন গাড়ি চলার এলাকাগুলোর বাস্তব অবস্থা ধারণের ব্যবস্থা নেয়া হয়। ২২টি ক্যামেরা ও সেন্সর ব্যবহার করে এলাকাগুলোর রাস্তা ও চারপাশের ছবি তোলা হয়। আশা করা হচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যেই চালকবিহীন গাড়ি প্রযুক্তি পূর্ণতা লাভ করবে। দেড় দশকের মধ্যেই এই প্রযুক্তি নিরাপত্তাও বাড়বে। তখন ইন্টারনেট-ভিত্তিক এসব চালকবিহীন গাড়ি যাত্রীদের নির্ধারিত স্থানে পৌঁছে দেয়ার পাশাপাশি তাদের সঙ্গে কথা বলা ও বিনোদন প্রদানেও সক্ষম হবে।

এবার কিছু প্রতিবন্ধকতা নিয়ে আলোচনা করা যাক। ট্রাফিকের লাল-সবুজ-হলুদ বাতি মেনে চলা  এবং রাস্তায় কোন যানবাহন বা ব্যক্তির অবস্থান বোঝার ক্ষেত্রে চালকবিহীন গাড়ি ফুল মার্কস পেয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন স্থানে এখনও কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়ে গেছে। যেমন ধরুন, আবহাওয়া, ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক ও অস্থায়ী ট্রাফিক লাইটে চালকবিহীন গাড়ি কিছুটা সমস্যায় পড়ে। এছাড়া এটি এখনো সাধারণ মানুষ এবং ট্রাফিক পুলিশের মধ্যে তফাৎ খুঁজে বের করতে পারেনি। তাই বর্তমানে চালকবিহীন গাড়ির চলাচলের এক প্রস্তাবে জরুরী প্রয়োজনে গাড়িতে একজন প্রশিক্ষিত চালক রাখার কথাও বলা হয়েছে। এরই মধ্যে ব্রিটেনের অনেক এলাকায় চালকবিহীন গাড়ি চলার ইতিবাচক ও নেতিবাচক বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণা চলছে। পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে ট্রাফিক জ্যাম ও সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাসে এই প্রযুক্তি কতটা ভূমিকা রাখতে পারে। চালকবিহীন গাড়ির যাত্রীদের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে তা নিয়েও গবেষণা হচ্ছে। একই সঙ্গে চালকবিহীন গাড়ি চলাচলে কী কী আইনী জটিলতা হতে পারে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। যুক্তরাজ্যের নাগরিকরা প্রতিবছর গড়ে ২৩৫ ঘণ্টা গাড়ি চালান। যা ৬ সপ্তাহের কর্মঘণ্টার সমান।

এবার একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে আসি, জার্মানির অন্যতম প্রধান শহর বার্লিনের প্রধান রেলওয়ে স্টেশনের কাছে প্রতিদিন প্রায় পনেরো লাখ গাড়ি চলে তার মধ্যে একটি ভূতুরে গাড়ি। এটিকে ভূতুরে গাড়ি বলা হয়, কেননা সে গাড়িতে ব্রেক, এ্যাক্সিলারেটর কিংবা স্টিয়ারিং, সবই কম্পিউটার চালিত। ভূতুরে গাড়ির চারপাশে যেসব গাড়ি চলছে বা পথচারীরা চলাফেরা করছেন, লেজার স্ক্যানার, রাডার ও ভিডিও ক্যামেরা দিয়ে তাদের খোঁজ রাখা হয়। বিশেষ একটি সফটওয়্যার সঙ্গে সঙ্গে ট্রাফিক পরিস্থিতি ধরতে পারে ও গাড়িকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেয়। সেফটির জন্য একজন ড্রাইভার সিটে বসে থাকলেও, গুরুতর বিপদ ছাড়া তিনি স্টিয়ারিং-এ হাত লাগান না। এ প্রসঙ্গে প্রফেসর ডক্টর রাউল রখাস বলেন,

‘ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত লাগে বৈকি, গাড়িতে বসে আছি অথচ কেউ গাড়ি চালাচ্ছে না! সেজন্য আগে থেকে মানসিক প্রস্তুতি লাগে। বিশেষ করে গাড়ি যখন ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার গতিতে মোটরওয়ে ধরে চলেছে আর আপনি দেখছেন, স্টিয়ারিং আপনি থেকে ঘুরছে! সে এক অদ্ভুত অনুভূতি।’

শুধু বার্লিনের জমাট ট্রফিকেই নয়, মোটরওয়েতে, যেখানে অনেক জায়গায় স্পিড লিমিট আছে সেখানেও চালকবিহীন গাড়ি ঠিকই তার চ্যানেল ধরে চলে। এই গাড়িতে ব্রেন হলো তার কম্পিউটার, সেই কম্পিউটারই নিজে থেকে গাড়ির চলাফেরা ঠিক করে দেয়। গাড়ির বুটে ভবিষ্যতের প্রযুক্তি, যা বিশেষ করে বিপদ এড়াতে সাহায্য করে। যানচলাচল বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডক্টর কার্স্টেন লেমারের কথায়,

‘ভবিষ্যতের পুরোপুরি স্বয়ংক্রিয় গাড়ির উপকারিতার একটা দৃষ্টান্ত হতে পারে এই যে, চালকের হার্ট এ্যাটাকের মতো সঙ্কটপূর্ণ পরিস্থিতিতে গাড়ি নিজেই সেটা বুঝে রাস্তার ধারে পার্ক করবে।’

আর এই সব কিছুই অর্জিত হয়েছে প্রযুক্তি বিপ্লবের কারণে। তাহলে প্রস্তুত থাকুন সে সময়টির যখন আপনার বাসার সামনে আপনার অফিস টাইমে ঘর থেকে বের হলেই দেখতে পাবেন, আপনার প্রিয় গাড়িটি। যার জন্য আপনাকে খুঁজতে হবে না অতিরিক্ত ড্রাইভার, এমনকি আপনাকেও ড্রাইভ করতে হবে না। এই সম্পর্কিত একটা ভিডিওর মাধ্যমে আজকের লেখার ইতি টানছি।

[youtube youtubeurl="2nSpQxpBcbY" ][/youtube]

 

 

রেফারেন্সঃ

  1. https://www.ucsusa.org/clean-vehicles/how-self-driving-cars-work#.WlJw0WiWbIU
  2. http://www.alphr.com/cars/7038/how-do-googles-driverless-cars-work
  3. https://en.wikipedia.org/wiki/Autonomous_car
  4. https://www.google.com/selfdrivingcar/
  5. https://www.theguardian.com/technology/self-driving-cars

লিখাটি নিয়ে আপনার অভিমত কি?