মায়ান সভ্যতাঃ
মায়ান সভ্যতার কথা তো আমরা অনেকেই শুনেছি। যেই সভ্যতা নিয়ে প্রত্নতাত্ত্বিকদের গবেষণার শেষ নেই। আমাদের এই আর্টিকেল লাইডার (LIDAR) টেকনোলজির সাহায্যে সম্প্রতি উদ্ধারকৃত মায়ান সভ্যতার এক হারিয়ে যাওয়া শহর নিয়ে। মায়ান সভ্যতার প্রতি এমনিতেই প্রত্নতত্ত্ববিদদের প্রবল আগ্রহ। আগ্রহ থাকবেই বা না কেনো? মায়ান সভ্যতা কৃষি থেকে শুরু করে বিভিন্ন কলা, গণিত, সঙ্গীত এবং জ্যোতির্বিদ্যায় সময়ের তুলনায় অনেক এগিয়ে ছিল। কিছু কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক এই সভ্যতার সময়কালকে মানব সভ্যতার এক সর্বোত্তম সময় বলেও অভিহিত করে থাকেন।
মায়ান সভ্যতার শুরু হয়েছিল আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২৬০০ বছর আগে। তবে আনুমানিক ১২০০ বছর আগে মায়ানরা নিজেদের অনেক এগিয়ে সভ্যতার এক সোনালী সময়ে অবস্থান করেছিলো। মায়ানদের পরিত্যক্ত শহর, স্থাপনা, ভাষা, পঞ্জিকা, অস্ত্রসহ নানান জিনিস ছিল তাদের সময়ের তুলনায় অনেক এগিয়ে। এজন্য এই সভ্যতা রহস্যময় এক সভ্যতা। প্রত্নতত্ত্ববিদরা এখনো তাদের এই এগিয়ে থাকার কারণ পুরোপুরি খুঁজে বের করতে পারেন নি। সেই সময়ে তৈরিকৃত বিশাল পাথরের মন্দির, মূর্তি, অন্যান্য অনেক স্থাপনা তাদের এক রহস্যের জালে পেঁচিয়ে রেখেছে।
সম্প্রতি আবিষ্কৃত মায়ান শহরঃ
সম্প্রতি লাইডার টেকনোলজির সাহায্যে নতুন এক মায়া সভ্যতার খোঁজ পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা, যা অনেক মায়া সভ্যতা বিশেষজ্ঞদের ও মাথা খারাপ করে দিয়েছে।
উত্তর গুয়াতেমালার এক জঙ্গল থেকে এমন ই এক সভ্যতা আবিষ্কৃত হয়েছে যা শত শত বছর আগের মায়ানদের সভ্যতার অংশ বলে দাবি করছে প্রত্নতত্ত্ববিদগণ। প্রায় ১০০০০০ ঘরবাড়ি, নানা ধরনের বিল্ডিং, প্রাসাদ, রাস্তা-ঘাট সহ তৈরি ছিল এই সভ্যতা যা এতদিন উত্তর গুয়াতেমালার জঙ্গলে গাছের নিচে ঢাকা পড়ে ছিল।
উত্তর গুয়াতেমালার কাছেই এক প্রাচীন শহর টিকাল(Tikal)। যেখানে মায়ান সভ্যতার বিভিন্ন প্রাচীন মন্দিরসহ অন্যান্য স্থাপনা দেখতে প্রায় পর্যটকেরা সেখানে যান। টিকাল শহরের টাওয়ারিং টেম্পল(Towering Temple) পর্যটকদের জন্য অনেক আকর্ষণীয় এক জায়গা। এই মন্দির দেখতে প্রতি বছর অনেক পর্যটক সেই শহরে যান।
সেই শহর এর কাছের জঙ্গলেই লাইডার প্রযুক্তির সাহায্যে প্রত্নতত্ত্ববিদরা প্রায় ৬০০০০ এর বেশি বাড়ি-ঘর, বিশাল প্রাসাদ, সমাধিস্থল এমনকি অনেক চওড়া বড় রাস্তা সহ এক শহরের হদিস পান।
এটি এতই প্রাচীন, মায়ান সভ্যতার সাথে এর গঠন এতটাই মিল এবং এর স্থাপনাগুলোর গঠন এতই মজবুত এবং দূরদর্শী যে অনেক অভিজ্ঞ প্রত্নতত্ত্ববিদরাও এর খোঁজ পাওয়ার পর অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। নতুন আবিষ্কৃত এই শহরের চারপাশে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য দেয়াল ও নির্মাণ করা হয়েছিলো।
প্রত্নতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ থমাস গ্যারিসন বলেন, "এটি আমরা যতটা আশা করেছিলাম তার চেয়ে অনেক বেশি গোছানো ছিল। আমরা অনুমান করেছিলাম এটি অনেক বড় এবং সুগঠিত এক শহরের মত হবে। কিন্তু পরে আমরা অবাক হয়ে গিয়েছিলাম, কারণ এটি আমাদের অনুমান থেকেও অনেক এগিয়ে ছিল।"
গুয়াতেমালার যেই জঙ্গল থেকে এই হারিয়ে যাওয়া শহরের হদিস বের করা হয় সেই জঙ্গল এতটাই ঘন যে, জঙ্গলের কয়েক ফুট উপর থেকেই আর কিছু দেখা যায় না ঘন গাছ আর পাতার ফলে। গবেষকরা প্লেন থেকে ওই ভূমির উপর লেজার রশ্মি ফেলেছিলেন যেন ঘন গাছের পাতা দিয়ে ঢাকা নিচের অংশের ধারণা পাওয়া যায়। এবং প্রাপ্ত তথ্যের সাহায্যে নিচের ভূমির একটি ত্রিমাত্রিক(Three Dimensional) চিত্র বানিয়েছিলেন। যেটি লাইট ডিটেকশান এবং রেঞ্জিং বা লাইডার(Lidar) প্রযুক্তি নামে পরিচিত।
লাইডার প্রযুক্তিঃ
LIDAR—Light Detection and Ranging এটি একটি remote sensing method. যার মাধ্যমে ভূমির উপরিভাগ এর বিভিন্ন পরীক্ষা করা যায়। এটি যে ভূ-তলের উপর পরীক্ষা চালানো হবে তার পরিসর ঠিক করতে আলো কে লেজার হিসেবে ব্যবহার করে। এবং এরপর সাথে বাতাসবাহিত আর কিছু তথ্য এক করে উক্ত ভূমির আকার এবং উপরিভাগ নিয়ে একটি ত্রিমাত্রিক ধারণা দেয়।
একটি লাইডার যন্ত্রে মূলত একটি স্ক্যানার, একটি লেজার এবং একটি বিশেষ GPS গ্রাহক যন্ত্র থাকে। বড় এলাকা থেকে লাইডার এর সাহায্যে তথ্য সংগ্রহ করার জন্য এরোপ্লেন বা হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হয়।
লাইডার প্রযুক্তির মাধ্যমে যে লেজার রশ্মি নিচে ফেলা হয় তা কোনো অবজেক্ট বা বস্তু পেলে সেখান থেকে প্রতিফলিত হয়ে ফিরে আসে। এবং কোনো গাছ কিংবা পাতা পেলে এটি সোজা ভূমিতে গিয়ে আঘাত করে। এই প্রযুক্তির সাহায্যে গবেষকরা ভূমিতে বিভিন্ন উঁচুনিচু ভারসাম্যহীন জায়গা দেখতে পান। সাধারণ চোখে দেখে যা হয়ত মনে হবে কোনো পাথরের ধ্বংসাবশেষ। প্রত্নতত্ত্ববিদরা তাদের অভিজ্ঞ চোখ দিয়েই সেই তথ্য যাচাই করে বিভিন্ন প্রাচীন স্থাপনা, রাস্তাঘাট, প্রাসাদ খুঁজে বের করেন। লাইডার প্রযুক্তি কোনো পরিবেশ এর কোনো স্থাপনা প্রাকৃতিক নাকি মানুষের দ্বারা তৈরি সেটা সম্পর্কেও সঠিক তথ্য প্রদান করতে পারে।
এই প্রযুক্তি আরো অনেক জায়গায় ব্যবহার করা হয়েছিল। কম্বোডিয়ার আঙ্গর ওয়াট মন্দির(Angar Wat Temple) এর আশেপাশে এই প্রযুক্তির সাহায্যে প্রাচীন হারিয়ে যাওয়া এক শহর খুঁজে পেয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা। সে অন্য এক ইতিহাস। পরে সেই ইতিহাস নিয়ে কখনও লেখা যাবে।
হারিয়ে যাওয়া মায়ান শহরঃ
তো যেখানে ছিলাম, এই পর্যন্ত যত প্রজেক্টে লাইডার প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়েছে তার মাঝে এটি ছিল সবচেয়ে বড়। ন্যাশনাল জিওগ্রাফির এক তথ্যমতে, প্রায় ৮০০ বর্গ মাইল এলাকা জুড়ে মায়ান এই শহরের বিস্তৃতি ছিল। প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল এখানে কয়েক মিলিয়ন মানুষ বসবাস করত এক সময়। কিন্তু লাইডার থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে এই হারিয়ে যাওয়া শহরে প্রায় ১০ মিলিয়নের ও বেশি মানুষ বসবাস করত।
Albert Yu-Min Lin এর মতে, এই বিশাল শহর যেটা জঙ্গলে হারিয়ে গিয়েছিল, এক মুহূর্তেই এর সকল তথ্য সামনে চলে এলো। তিনি আরো বলেন, "যেখানে সবাই ভাবছিল এই বিস্তৃত সভ্যতা(মায়ান সভ্যতা) আমরা অনেক ভালোভাবে উদ্ধার করেছি এবং এর উপর যথেষ্ট গবেষণা করা হয়ে গেছে সেখানে এখন নতুন এক পৃথিবী উন্মুক্ত হল। লাইডার প্রযুক্তির সাহায্যে এর অবস্থান নির্ণয় একটিমাত্র ধাপ শুধু। আরো অনেক ধাপ এখনও বাকি। এখন পর্যন্ত যে তথ্য পাওয়া গেছে তা যাচাই করা হয়নি। কারণ যে জঙ্গলে এই শহর হারিয়ে গেছে সেই জঙ্গল অনেক বিষাক্ত সাপ, ঝাঁকে ঝাঁকে বিষাক্ত মৌমাছি এবং বিষাক্ত মাকড়সা সহ অনেক বিপদসংকুল প্রাণীর অভয়ারণ্য।"
তবে এই প্রকল্প প্রথমে শুরু করেছিলো প্যাকুনাম(Pacunam) নামক গুয়াতেমালার এক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। যাদের আর্থিকভাবে অনুদান দিয়েছিল University of Houston এর National Centre of Airborne Laser Maping.
প্যাকুনামের এই প্রকল্পের প্রথম ধাপে ওই এলাকার ৫০০০ বর্গ মাইল এলাকায় লাইডার প্রযুক্তি ব্যবহার করে পরীক্ষা চালানোর পরিকল্পনা ছিল। এবং প্রথম ধাপেই লাইডার প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই পরীক্ষা চালানোর জন্য $৬০০০০০০(৬ লক্ষ ডলার) বাজেট ঠিক করা হয়। এবং এই প্রকল্পের সময়কাল ঠিক করা হয় ৩ বছর। কে জানে আর কোন রহস্য লুকিয়ে আছে এই ৫০০০ বর্গ মাইল এলাকায়।
আগ্রহীরা নিচের ভিডিওটি দেখে নিতে পারেন।
রেফারেন্সঃ
- https://www.theverge.com/2018/2/4/16970706/lidar-lasers-mayan-civilization-guatemala-archeology
- http://www.ancientpages.com/2018/02/03/lidar-technology-reveals-secrets-of-ancient-maya-civilization/
- https://news.nationalgeographic.com/2018/02/maya-laser-lidar-guatemala-pacunam/#/01-lidar-maya.jpg