কোয়ান্টাম কম্পিউটার কি আগামী দিনের কম্পিউটার?

গত কয়েক বছর ধরেই শোনা যাচ্ছে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের কথা। এ যেন ছোটবেলায় রেডিওতে শোনা সেই জলদগম্ভীর কণ্ঠস্বর: আসিতেছে … অমুক সিনেমা! কোয়ান্টাম কম্পিউটারের ক্ষেত্রেও সেই একই কথা খাটে। মনে হচ্ছিল চোখের পলকেই কোনো একদিন এসে যাবে সেই কম্পিউটার, কোটি কোটি বিলিয়ন বিলিয়ন ডাটা চোখের পলকে প্রক্রিয়াকরণ করা যার কাছে ডাল ভাতের চাইতেও সহজ ব্যাপার হবে।

কোয়ান্টাম কম্পিউটার নামের এই মহাকম্পিউটারের কাছে আজকের ডিজিটাল কম্পিউটারকে মনে হবে ছেলেখেলা। তথ্য প্রক্রিয়াকরনের দানব কোয়ান্টাম কম্পিউটার অ্যাটম আর ইলেকট্রনের শক্তিতে কম্পিউটিং-এর গোটা ভুবনকে এলোমেলো করে দেবে। কিন্তু মুশকিল হল, আমাদের প্রতীক্ষার সেই দিন যেন আর শেষ হচ্ছে না। ২০০৭ সালে ডি-ওয়েব নামে একটি কানাডীয় প্রতিষ্ঠান ঘোষণা করল তারা একটি কোয়ান্টাম কম্পিউটার আবিষ্কার করেছে যেটি সুডোকু ধাঁধাঁর সমাধান করতে পারে। কিন্তু এখনও সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়নি ওটি আসলেই কোয়ান্টাম কম্পিউটার ছিল কি না।

সুডোকু সমাধানকারী কোয়ান্টাম চিপ এর ভেতর ডিজাইন।                                 চিত্র: সুডোকু সমাধানকারী কোয়ান্টাম চিপ এর ভেতর ডিজাইন।

 

তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, হতাশ হবার কোনো কারণ নেই। আজ হোক বা কাল, কোয়ান্টাম কম্পিউটার বাস্তবে রূপ নেয়াটা এখন শুধুই সময়ের ব্যাপার। ‘ইউএস ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব স্ট্যান্ডার্ডস এন্ড টেকনোলজি’র বিজ্ঞানী ড. ডেভিড ওয়াইনল্যান্ড-এর কথা ধার করে বলতে হয়, ‘কোয়ান্টাম কম্পিউটিং-এর ক্ষেত্রে যেটুকু অগ্রগতি ঘটেছে তাকে নাটকীয় বললেও কম হয়।’ তিনি মনে করেন, ডিজিটাল কম্পিউটার যেমন বিংশ শতকে আমাদের জীবনে যুগান্তকারী সব পরিবর্তন এনে দিয়েছিল কোয়ান্টাম কম্পিউটারও সেই একই কাজ করবে, এ শতকে।

কোয়ান্টাম কম্পিউটারের পেছনের ধারণাটা খুবই সহজ সরল। আমাদের পরিপার্শ্বের দিকে তাকালে আমরা কী দেখতে পাই? একটি বস্তু হয় ‘এটা’ নইলে ‘ওটা’। অর্থাৎ, কোনো কিছু একই সঙ্গে দুটি অবস্থা ধারণ করতে পারে না। একটা গাছ একই সঙ্গে গাছ আবার পাখি হতে পারে না। কিন্তু অ্যাটম (পরমাণু) এবং ইলেকট্রন (ঋণাত্মক বিদ্যুৎ শক্তিসম্পন্য পদার্থের পরমাণু কণা)-এর মত পদার্থের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ভিন্ন।  অ্যাটম বা ইলেকট্রন কেবল এটি বা ওটি-র মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। তারা একই সঙ্গে এটাও হতে পারে, আবার হতে পারে ওটাও – অর্থাৎ এরা যুগপৎ দুটি অস্তিত্ব বা বৈশিষ্ট্য ধারণ করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, তারা একই সঙ্গে ঘড়ির কাঁটার দিকে (clockwise) এবং ঘড়ির কাঁটার উল্টো দিকে (anticlockwise) ঘুরতে পারে অথবা একই সঙ্গে দুটি ভিন্ন energy state ধারণ করতে পারে। এটি সুপারপজিশন (superposition) নামে পরিচিত।

এনট্যাঙ্গলমেন্ট জিনিসটা সহজ নয়..                                             এনট্যাঙ্গলমেন্ট জিনিসটা সহজ নয়..

এখানেই শেষ নয়। এসব কোয়ান্টাম বস্তু দু’য়ে মিলে এক হয়ে যেতে পারে এবং তখন একটাকে কিছু করা হলে তা প্রভাব ফেলবে অন্যটির ওপরও। এ ব্যাপারটিকে বলা হয় এনট্যাঙ্গলমেন্ট (entanglement), আলবার্ট আইনস্টাইন যাকে বলেছিলেন, ‘দূর থেকে ঘটনো ভৌতিক কান্ডকারখানা’। এই সুপারপজিশন আর এনট্যাঙ্গলমেন্ট কম্পিউটিং-এর ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হলে কম্পিউটারের হাতে চলে আসতে পারে অবিশ্বাস্য ক্ষমতা।

উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা পরিস্কার করা যাক। ট্রানজিস্টর কারেন্টের মত প্রথাগত কম্পিউটার বিট-এর কথাই ধরুন। কম্পিউটারের একটি বিট দুটো মাত্র অবস্থা ধারণ করতে পারে, হয় ১ (on) নয়ত ০ (off)। কিন্তু কোয়ান্টাম
কম্পিউটিং-এর যে বিট তার নাম কিউবিট। সুপারপজিমনের সুবাদে সেই কিউবিট একই সঙ্গে দুটো অবস্থা ধারণ করতে পারে, অর্থাৎ কিউবিট একই সঙ্গে হতে পারে ১ এবং ০ দুটোই। ফলে একটি কিউবিট সাধারণ বিটের চাইতে দ্বিগুণ পরিমাণ তথ্য ধারণ করতে পারে। এখানেই ঘটনা শেষ নয়। এনট্যাঙ্গলমেন্টের কথাও ভুলে গেলে চলবে না। একাধিক বিট একত্রিত হয়ে একটি নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যে নিজেদের সুপারইম্পোজ্ড অবস্থা পরস্পরের সঙ্গে শেয়ার করতে পারবে। ফল যা দাঁড়াবে তা হচ্ছে, কিউবিট যত বাড়বে কম্পিউটারের শক্তিও জ্যামিতিক হারে কেবল বাড়তেই থাকবে। ৭ সংখ্যাটাকে ধারণ করার জন্য যেখানে আমাদের প্রথাগত বিট লাগে তিনটি, সেখানে মাত্র ৩ কিউবিট ০ থেকে ৭ সমস্ত সংখ্যাকেই ধারণ করতে পারবে। অর্থাৎ বিশ্বপ্রকৃতিতে যত পরমাণু আছে তার চাইতেও বেশি সংখ্যা ধারণ করতে পারবে মাত্র কয়েকশ কিউবিট। একবার ভেবে দেখেছেন কি মারাত্মক কথা?

কিন্তু মুশকিল হল, কাগজে কলমে এ সবই সম্ভব হলেও কোয়ান্টাম কম্পিউটিং-কে বাস্তবে রূপদান করতে পারবে এমন প্রসেসর এখনও তৈরি হয়নি। বর্তমানে কিউবিট নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষার কাজ করা হচ্ছে ion-trap নামে পরিচিত একটি কৌশলের সাহায্যে। এ কৌশলে দোলায়মান বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র (oscillating electric fields) ব্যবহার করে পরমাণুর ion (ইলেকট্রনের হ্রাস বা বৃদ্ধির দ্বারা বিদ্যুতায়িত কণিকা)-কে এক জায়গায় আটকে রাখা হয়। প্রতিটি আয়নের এনার্জি স্টেটে তথ্যকে সংকেতবদ্ধ করে রাখা হয়। প্রথাগত প্রসেসরে যেখানে কম্পিউটিং-এর কাজটি করা হয় ট্রানজিস্টর কারেন্টকে অন এবং অফ এ দুটো অবস্থার মধ্যে পরিবর্তিত করে, আয়ন ট্র্যাপ কৌশলে কিউবিটকে পরিবর্তিত করার কাজটি করা হয় বিশেষভাবে ডিজাইন করা লেজার রশ্মির সাহায্যে আয়নকে একটি নির্দিষ্ট সুপারপজিশন্ড অবস্থায় নিয়ে গিয়ে।

বেশ কিছুদিন আগে ওয়াইনল্যান্ড এবং তাঁর বিজ্ঞানী বন্ধুরা কোয়ান্টাম কম্পিউটিং-এর ক্ষেত্রে বেশ বড় ধরনের একটি সাফল্য লাভ করেন। তাঁরা খুবই সতর্কতার সাথে দুটো আয়নের ওপর লেজার রশ্মি প্রয়োগ করে কিছু সহজ সরল গণনা কার্যসম্পন্য করেন। আয়নগুলোতে রক্ষিত তথ্যের কোনো ক্ষতি না করে তাঁরা সেগুলোকে প্রসেসরের আশেপাশে ঘোরাতে এবং একই গণনা কাজ পুনরায় করতেও সক্ষম হন। অন্যভাবে বলতে গেলে, একটি মৌলিক প্রথাগত কম্পিউটার যে কাজগুলো করে তাঁরাও কোয়ান্টাম কম্পিউটিং-এর সাহায্যে সেই একই কাজগুলো করতে সমর্থ হন।

পরবর্তীতে আট থেকে নয়টি আয়ন দিয়েও তাঁরা প্রায় একই ফল লাভে সক্ষম হয়েছেন। কাজেই অদূর ভবিষ্যতে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং-এর জগতে তাঁরা এবং অন্যান্য বিজ্ঞানীরা যে আরো বড় বড় সাফল্য লাভ করতে পারবেন তা নিয়ে সন্দেহ নেই তেমন একটা। এখন কেবল অপেক্ষা, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং-এর আশীর্বাদে কম্পিউটারের ভুবনে পরবর্তী বিপ্লবটা কত তাড়াতাড়ি সংঘটিত হয়, আর সেটি আমাদের জীবনকে আরো কতটা পাল্টে দেয়!

তথ্যসূত্র: http://www.tech.net.bd/istiakmahmud/2011/02/quantam-computer-isit-fantasy-or-reality/

লিখাটি নিয়ে আপনার অভিমত কি?