চিনি, কোকেইন থেকেও মারাত্মক আসক্তির!

1266

শিরোনাম শুনে অনেকেই হয়ত ভাবছেন চিনি কিভাবে ক্ষতিকর হয় তাও বার কোকেইন নামক জিনিস থেকে! গবেষণা বলছে, কোকেইন থেকে ১ নয়, ২ নয় , ৮ গুণ বেশী আসক্তিকারক বা নেশাকর হচ্ছে চিনি! যারা মিষ্টিজাতীয় খাবার খুব পছন্দ করেন তারা হয়ত ইতিমধ্যে আঁতকে ও উঠেছেন। আপনি যদি চিনিজাতীয় খাবার খুব পছন্দ এবং সুস্বাদু মনে করে থাকেন তবে এই লেখা অবশ্যই আপনার জন্য এবং সাথে এটি দুঃসংবাদ-ও।

চিনি কোকেইন থেকেও ক্ষতিকর এবং নেশাকর!
চিনি কোকেইন থেকেও ক্ষতিকর এবং নেশাকর!

"চিনি" শব্দটি শুনতে মিষ্টি মনে হলেও আমাদের শরীরে এর প্রভাব শুনলে আর তাকে মিষ্টি লাগবে না। তবুও যদি মিষ্টি লাগে এবং খেতে ইচ্ছে করে তাহলে ধরে নিতে পারেন, আপনি ইতিমধ্যে আসক্ত হয়ে গেছেন।

আমাদের শরীরে চিনি কিভাবে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে?

সরাসরি কিংবা বিভিন্ন খবারের সাথে মিশ্রিত অবস্থায় অতিরিক্ত চিনি গ্রহণ বিভিন্ন হৃদরোগ, স্থূলতা, ইনসুলিন প্রতিরোধকতা, নিম্নমানের ইমিউনিটি, মস্তিষ্কের বিভিন্ন অসুখ সহ আরো স্বাস্থ্যসমস্যা ঘটাতে সক্ষম।

আমাদের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় মাত্র এক চা চামচ পরিমাণ চিনি বছরে আমাদের শরীরে এক কেজি পরিমাণ চর্বি বাড়াতে সক্ষম, অন্যান্য সমস্যা গুলো যদি বাদ ও দেই। আমরা বেশিরভাগ মানুষ ঠিকমত জানিই না যে আমরা কি পরিমাণ চিনি দৈনিক গ্রহণ করছি। এমনকি আমাদের সংস্কৃতিতে যে কোনো আনন্দ আমরা উদযাপন করি মিষ্টিজাতীয় খাবার খেয়ে। সুতরাং রাতারাতি এটাকে নির্মূল করা সম্ভব নয়।

আমরা সাধারণত জানি, ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে চিনি খুব খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে। কিন্তু চিনির খারাপ প্রভাব এর চেয়েও বেশি। অতিরিক্ত চিনি গ্রহণ উপরে উল্লিখিত রোগ ছাড়াও মরণব্যাধি ক্যান্সারের ঝুঁকিও বাড়িয়ে দেয়।

প্রকৃতপক্ষে চিনি গ্রহণ কে নেশার সাথে তুলনা করা যায়। যত আপনি গ্রহণ করবেন, ঠিক তত আরো ইচ্ছে করবে। চিনি মস্তিষ্কের সুখ কেন্দ্র আঘাত করতে Narcotic  এর মত একই স্নায়বিক পথ ব্যবহার করে। এবং সিগন্যাল পাঠাতে থাকেঃ “আরো খাও,আরো খাও”

Narcotic একটি গ্রীক শব্দ। চিকিৎসা শাস্ত্রে এটি দিয়ে যে কোনো চিত্ত প্রভাবকারী উপাদান কে বোঝায় যা ক্লান্তির মাধ্যমে ঘুম নিয়ে আসে।

নিউরোসায়েন্টিস্ট Joseph Schroeder বলেন, গবেষণা করে দেখা গেছে, উচ্চমাত্রার চর্বি/উচ্চমাত্রার চিনি জাতীয় খাবার ঠিক ড্রাগের মতই আমাদের মস্তিষ্ককে উদ্দীপিত করে। এজন্যই দেখা যায়, এইসব খাবার শরীরের জন্য ক্ষতিকর জেনেও আমরা তা থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারিনা।

এক সময় গবেষকরা ধারনা করতেন জাংক ফুড এর নেশা যে কোনো নেশাজাতীয় দ্রব্যের চেয়েও বেশি নেশাদায়ক। তারা এখন দাবী করছেন চিনি কোকেইন থেকেও প্রায় আট গুণ বেশী নেশাদায়ক। যারা জাংক ফুড সম্পর্কে জানেন না তাদের জন্য একটু বলে নেই, যেসব খাবার বাহ্যিকভাবে অত্যন্ত চকচকে, কুড়মুড়ে, মজাদার মনে হয় কিন্তু খাদ্যগুণ বিচার করলে সেটা নিম্নমানের হয়ে থাকে তাদের সাধারণত জাংক ফুড বলা হয়।

Mount Sinai তে অবস্থিত Icahn School of Medicine এর গবেষক Dr. Nicole Avena পিজ্জাকে সবচেয়ে নেশাদায়ক খাবার বলেছে কারণ এর এক স্লাইসেই অনেক পরিমাণ চিনি থাকে।

 

Some more and least addictive foods
Some more and least addictive foods

পিজ্জা তে যে পরিমাণ টমেটো সস ব্যবহৃত হয় সেটা কয়েক পিস ওরিও বিস্কুট এ থাকা চিনির থেকেও বেশি। এবং গবেষণা মতে, ওরিও যে কোনো ড্রাগ এর মতই নেশাদায়ক। সরাসরি বললে বলা যায়, কোকেইন এবং হেরোইন থেকে বেশি নেশাদায়ক হচ্ছে ওরিও।

ওরিও বিস্কুট

আরো কিছু এরকম নেশাদায়ক খাবার হল চিপস, কুকিস এবং আইসক্রীম। শসা কে বলা হয় সবচেয়ে কম নেশাদায়ক খাবার। এর পরেই আছে গাজর।

Dr. Avena তার গবেষণায় খুঁজে পান, কিছু খাবারের প্রতি আমাদের আগ্রহ এবং আকর্ষণ অনেকটা নেশার কাছাকাছি। যাদের গ্লাইসেমিক ইন্ডেক্স এর মান বেশি তাদের ই সাধারণত নেশাজাতীয় খাবার বলা হয়।

গ্লাইসেমিক ইনডেক্স সম্পর্কে একটু জেনে নেয়া যাক। কোনো একটি নির্দিষ্ট খাবারে কার্বোহাইড্রেট এর পরিমাণ একটি সংখ্যামান এর সাহায্যে প্রকাশ করা হয়। এই মানের সাহায্যে কোনো একজন মানুষের রক্তের গ্লুকোজ এ উক্ত খাবারে উপস্থিত কার্বোহাইড্রেট এর প্রভাব বোঝা যায়। এই মানের সাহায্যে কোনো খাবার গ্রহনের দুই ঘন্টা পর উক্ত খাবারের কারণে তার রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বৃদ্ধি বোঝা যায়।

বেশ কিছু গবেষণামতে, যে আচরণগত লক্ষণগুলো মাদকদ্রব্য এবং অ্যালকোহলের আসক্তির কারণ হিসেবে ধরা হয়, অত্যন্ত-চকচকে, অত্যন্ত প্রক্রিয়াজাত খাবারও মস্তিষ্কে একই রকম আচরণ ও পরিবর্তনগুলি তৈরি করতে পারে।

University of Missouri–Kansas City এর হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ জেমস ও'কিফ বলেছেন যে, চিনি কার্ডিওভাসকুলার রোগ যেমন, হার্ট এট্যাক, হার্ট স্ট্রোক, এছাড়াও লিভারের বিভিন্ন রোগসহ, উচ্চ রক্তচাপ, টাইপ ২ ডায়াবেটিস, স্থূলতা এবং আলজেইমার রোগ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে রাখে। একটা সময় খাদ্যে কাচা লবণ কে রক্তচাপ বাড়াতে সহায়ক হিসেবে ভাবা হত। সাম্প্রতিক কিছু গবেষণায় ধারণা করা হচ্ছে , চিনি রক্তাচাপ বৃদ্ধিতে লবণের চেয়েও বেশি ভূমিকা পালন করে।

ওকিফ আরো বলেন, আমরা যখন প্রক্রিয়াজাত খাবার হিসেবে গমের ময়দা এবং চিনি গ্রহণ করি তখন এটি ইনসুলিন থেকেও দ্রুত আমাদের রক্তে চিনির পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। এতে হরমোনের বিভিন্ন বিরুপতা তৈরি হয় এবং এই খাবারের ফলে উৎপন্ন চর্বি আমাদের পেটে সঞ্চিত হয়। এবং মিষ্টি জাতীয় কিংবা জাংক ফুড এর প্রতি আমাদের ক্ষুধা আরো বাড়িয়ে দেয়।

কিভাবে এই আসক্তি বা নেশা দূর করা যায়?

ড্রাগ এর নেশা দূর করতে বিভিন্ন রিহ্যাব সেন্টার থাকলেও চিনির নেশা দূর করতে তেমন কোনো নিরাময় কেন্দ্র এখন পর্যন্ত নেই। সুতরাং এই নেশা থেকে বের হয়ে আসতে ব্যক্তিগত উদ্যোগ এর বিকল্প নেই।

ওকিফ বলেন, চিনির প্রতি আসক্তি দূর করতে আনুমানিক ৬ সপ্তাহের মত লাগে। এবং এই সময়টাতে নিজেকে চিনিজাতীয় খাবার থেকে দূরে রাখতে যে পরিমাণ কষ্ট হয় সেটা একজন নেশায় আক্রান্ত মানুষ কে নেশা ছাড়ার সময় যে কষ্ট হয় তার সমান। তবে শেষ পর্যন্ত উত্তীর্ণ হলে এই কষ্ট স্বার্থক। রক্তচাপ কমে যাবে, ডায়াবেটিস দূর হয়ে যাবে, স্থূলতা থাকবে না, গায়ের রঙ ফ্রেশ হবে, মুড পরিষ্কার থাকবে, ঘুমের উন্নতি হবে। এটা সত্যিই চোখে পড়ার মত ব্যাপার হবে।

Dr. Hyman এর মতে, চিনি খাওয়া ছেড়ে দেয়া মানে শুধু ডেজার্ট কিংবা মিষ্টি খাওয়া ছেড়ে দেয়া নয়। আমাদের আরো গভীর থেকে ভাবতে হবে এবং এই সমস্যা উৎপাটনে চেষ্টা করতে হবে। তবে শুরুতে একেবারে ছেড়ে দেয়া সহজ কথা নয় যেহেতু এটি আসক্তিকারক খাবার। তাই মিষ্টি কিংবা ডেজার্ট ছেড়ে দেয়াটা অবশ্যই চমৎকার উদ্যেগ। তবে আমাদের ধীরে ধীরে প্রতিটা খাবারে উপস্থিত চিনির মাত্রা জেনে তা থেকে আস্তে আস্তে দূরে সরে আসতে হবে। প্রক্রিয়াজাত খাবার থেকে যতটা পারা যায় নিজেকে দূরে রাখার চেষ্টা করতে হবে।

বলা যায় এটাকে একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে ধীরে ধীরে একটু একটু করে সরে আসতে হবে। নিচে একটা নমুনা দেয়া হল যেভাবে যে কেউ চাইলে এই চ্যালেঞ্জ শুরু করতে পারেন।

Sugar free Challenge

এছাড়াও Dr. Hyman প্রতিদিনের খাদ্য তালিকা থেকে নিচের খাদ্যগুলো সরিয়ে ফেলতে পরামর্শ দিয়েছেনঃ

মিষ্টিজাতীয় যে কোনো পানীয় কিংবা সোডা গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে বলেছেন। Dr. Hyman তার পরিচিত এক রোগীর কথা বলতে গিয়ে বলেন যে, তার সেই রোগী শুধুমাত্র সোডা গ্রহণ বন্ধ করে তার ওজন ৭৫ পাউন্ড কমাতে সক্ষম হয়েছিলেন।

খুব সহজে পাওয়া যায় এবং ঝামেলা ছাড়া খাওয়া যায় এসব খাবার পরিহার করতে বলেছেন। কারণ এই ধরনের বেশিরভাগ খাবার ই এমনভাবে তৈরি যেন দেখতে ভালো লাগে, দেখেই খেতে ইচ্ছে করে এবং খেতেও মজাদার। পুষ্টিগুণ বিবেচনা করে এসব খাবার তৈরি হয়না।

এছাড়া বাজারে যেসব দুগ্ধজাতীয় খাবার পাওয়া যায় তাও পরিহার করতে বলেছেন।

No sugar plan

তাহলে প্রশ্ন আসে কি খাওয়া উচিত?

ওকিফ এর মতে আমাদের দৈনন্দিন ডায়েট এ যেসব অবশ্যই থাকা উচিত তা হল, প্রচুর পরিমাণ শাক সবজি, প্রচুর ফল এবং বাদাম জাতীয় খাবার, জাম, মাছ, মুরগির বুকের মাংস আর বিশুদ্ধ পানি। চিকিতসাবিজ্ঞানীরা সরাসরি কিংবা প্রক্রিয়াজাত খাবার হিসেবে চিনি গ্রহণ না করে প্রাকৃতিকভাবে মিষ্টি জাতীয় খাবার গ্রহণ কে উৎসাহিত করেছেন। তবে ফলের ভেতরেও লো সুগার এর ফল বেশি খেতে বলা হয়েছে হাই সুগার এর ফলের তুলনায়।

Comparatively high and low sugar fruit

 

পরিশেষে বলা যায়, এই আসক্তি কে এখন থেকে নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে তা আমাদের ভয়াবহ রকমের স্বাস্থ্য ঝুঁকির দিকে ঠেলে দিবে অচিরেই।

নিউরোসায়েন্টিস্ট Jamie Honohan বলেন, এমন কি এসব উচ্চমাত্রার চর্বি কিংবা চিনিজাতীয় খাবার কোকেইন বা হেরোইন থেকেও বেশি ভয়াবহ আকারে স্বাস্থ্যসমস্যা ঘটাতে পারে কারণ হেরোইন কিংবা কোকেইন এর তুলনায় এসব খবই সুলভ। তাই আমাদের নিজেদের এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কে এই আসক্তির হাত থেকে বাঁচাতে সচেতন হতে হবে এখন থেকেই।

Reference:

লিখাটি নিয়ে আপনার অভিমত কি?