ধরুন, আপনার পছন্দের একটি কাপড় ভেজা দেখে চুলায় শুকাতে দিলেন, কাপড় শুকানো হল, আপনি খেয়াল না করায় একটা সময় পরে আগুনে পুড়ে গেল! কেন এমন হল? ভেবেছেন কি?
আমরা অনেকে চিকেন গ্রিল বা পোড়া মুরগি খেতে খুব পছন্দ করি, খাওয়ার আগে কখনো চিন্তা করেছি, কিভাবে মুরগিগুলো পোড়ানো হচ্ছে? আবার দেখেন প্রতিবছর কত বন আগুনে পুড়ে যায়, আর বনের গাছের কাঠ পুড়ে কয়লা হয়। কখনো আমাদের চিন্তায় এসেছে কি কিভাবে গাছ পুড়ে কয়লা হয়!
এত প্রশ্নবোধক চিহ্ন যেই বিষয়টি ইঙ্গিত করে তা হল আগুন... হুম...! ঠিকই শুনেছেন। ইংরেজিতে যা Fire নামে পরিচিত। এই আগুন জীবনের অতি প্রয়োজনীয় ও অপরিহার্য একটি জিনিস। দুটি পাথর ঘষে আগুন আবিষ্কার পর থেকেই আগুন ব্যবহার হয়ে আসছে। আগুন এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, বর্তমান সভ্যতা আগুন ছাড়া কল্পনাই করা যায় না।
আগুনে কোন কিছু কেন পুড়ে এর উত্তর জানার আগে জানতে হবে আগুন কি? আমরা কিভাবে আগুন পাই?
আগুন কি? কিভাবে আগুন পাই?
আমরা সবাই কম-বেশি জানি, যে বিক্রিয়ায় কোনো রাসায়নিক সত্তা যেমনঃ অণু, পরমাণু বা আয়ন যখন ইলেকট্রন গ্রহন করে তখনই বিজারণ বিক্রিয়া সংগঠিত হয়। আর যে সকল রাসায়নিক সত্তা ইলেকট্রন গ্রহন করে তাই জারক। বায়ুর অক্সিজেন জারক পদার্থ। আর বায়ুর অক্সিজেন বা জারক পদার্থের উপস্থিতিতে তাপের সহায়তায় কোন বস্তু যে রাসায়নিক বিক্রিয়া সংগঠিত করে, তাই দহন বিক্রিয়া। আর দহন বিক্রিয়ায় শক্তি নির্গত হয়।
আমরা জানি, পরমাণুর কেন্দ্রে থাকে প্রোটন আর নিউট্রন। আর কেন্দ্রকে ঘিরে থাকে নির্দিষ্ট শত্তির কক্ষপথ যা শক্তিস্তর নামে পরিচিত। পরমানুর ইলেক্ট্রনগুলো কক্ষপথে ঘুর্নায়নরত অবস্থান করে থাকে। এই ইলেকট্রনগুলো পরিবেশ থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ শক্তি গ্রহণ করে কম শক্তির স্তর থেকে বেশি শক্তির স্তরে যেতে পারে। আবার নির্দিষ্ট শক্তির তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ বিকিরণ বা নির্গমন করে বেশি শক্তির স্তর থেকে কম শক্তির স্তরে ফিরে আসে। এই তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ বিকিরণে নির্দিষ্ট মানের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য বের হয়। তরঙ্গগুলো দৃশ্যমান আলোর সাথে মিলে গেলে আমরা সেই রঙের আলো দেখতে পাই তাই আগুন। আর তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ বিকিরণ বা নির্গমনের ফলে শক্তি নির্গত হয় ফলে তাই তাপ।
ইলেকট্রনের শক্তির গ্রহন ও বিকিরন
সাধারণ কথায় বলতে পারি, দহন বিক্রিয়ার ফলে যে শক্তি নির্গত হয় তা তাপ, আর যে তরঙ্গ দৈর্ঘ্য নির্গত হয় আমাদের দৃশ্যমান সীমার মাঝে থাকলে আমাদের চোখে ধরা পরে, তাই আগুন। আবার, পর্যাপ্ত পরিমান অক্সিজেনের অনুপস্থিতিতে পরমাণুগুলো তাপে উত্তেজিত হলেও আগুন পাওয়া যায়। কারণ, সব উত্তপ্ত কণা আলো বিকিরণ করে।
আগুন জ্বালাতে সাধারণত ৩টি জিনিসের দরকার হয়:
- জ্বালানি,
- জারক পদার্থ (অধিকাংশ ক্ষেত্রে অক্সিজেন), এবং
- তাপ।
শুধুমাত্র জ্বালানী আর অক্সিজেন থাকলেও পর্যাপ্ত তাপের অনুপস্থিতি থাকার কারনে আগুন জ্বলে না। তাই তিনটাই আমাদের প্রয়োজন।
আপনারা ফায়ারবক্স বা আকিজ ম্যাচ বক্স দেখেছেন সবাই। সেখানে আপনারা অবশ্যই খেয়াল করেছেন, দুইপাশে খসখসে অংশ থাকে। যেখানে বারুদ মাখা কাঠি ঘসে উত্তপ্ত করা হয়। আর জ্বালানী হিসাবে থাকে সেলুলোজ বা কাঠ জাতীয় পদার্থ। ঘসার পর তাপ উত্তপ্ত হয় আর বায়ুর অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে আগুন পাই। লাইটারে বা পাথরে পাথর ঘষে আগুন উত্তপ্তের সময় একই ঘটনা সংগঠিত হয়।
নিচের ভিডিও টি দেখলে আপনারা সহজে বুজতে পারবেন
[youtube]https://www.youtube.com/watch?v=tMDKeBaLWDw[/youtube]
কোন কিছু কেন আগুনে পুড়ে?
আগুনে কোন পদার্থ কেন পুড়ে যায় তা কয়েকটি উদাহরণ দিলে সহজে বুজা যাবে। চলুন এগুনো যাক।
কাঠ আগুনে পুড়ে কেন কয়লায় পরিণত হয়.....?
আমরা জানি কাঠ সেলুলোজ জাতীয় পদার্থ। যা একধরনের শক্ত বা ভারী জৈবযৌগ। যেখানে কার্বন- হাইড্রোজেন থাকে। আগুনের সংস্পর্শে কাঠ আসলে বায়ুর অক্সিজেনের উপস্থিতে একধরনের রাসায়নিক বিক্রিয়া সংগঠিত হওয়া শুরু হয়। যা দহন নামে পরিচিত। দহনে অনেক তাপ উৎপন্ন হয়।
দহনের সময় কাঠের তাপমাত্রা বাড়াতে শুরু করে। যা ২৬০-৩১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ধীরে ধীরে কাঠের উপাদানগুলো ভাঙতে শুরু করে। এ প্রক্রিয়াকে পাইরোলসিস বলা হয়। পাইরোলসিস একটি তাপোৎপাদী প্রক্রিয়া, পাইরোলসিসের ফলে তাপ বের হতে থাকে।
এ প্রক্রিয়ায় কার্বন-ডাই-অক্সাইড, মিথেন এবং মিথানল সহ অনেকগুলো রাসায়নিক পদার্থ নির্গত হয়। যা হালকা হাইড্রোকার্বন এবং দাহ্য পদার্থ ফলে আগুন ভালোভাবে জ্বলতে শুরু করে। অতিরিক্ত রাসায়নিক পদার্থ হিসাবে ম্যাগনেসিয়াম, ক্যালসিয়াম আর পটাশিয়াম ইত্যাদি নিচে পড়ে থাকে। কাঠের বড় অংশ কার্বন ডাই অক্সাইড তৈরি করে যা বাতাসে মিলিয়ে যায় আর বেশ কিছু অংশ কয়লা হয়। কাঠে থাকা অপদ্রব্যগুলো ধোঁয়া সৃষ্টি করে।
Link:
মানুষের শরীর আগুনে পুড়ে কেন?
মানুষের শরীর হল হাইড্রোকার্বনের সমষ্টি। যা আগুন জ্বলার সহায়ক। মানুষের শরীর যখন আগুনের সংস্পর্শে আসে তখন শরীরের ত্বক সঙ্কুচিত হয়ে যায়। ফলে ভিতরের হাইড্রো কার্বনগুলো আগুনের সংস্পর্শে জ্বালানী হিসাবে কাজ করে এবং বাতাসের সংস্পর্শে দহন বিক্রিয়া সংগঠিত হয়ে কার্বন-ডাই-অক্সাইড আর পানি উৎপন্ন করে যা জলীয় বাষ্প হয়ে উড়ে যায়।
ধারনা করা হয় যে, মানুষের শরীরে যথেষ্ট পরিমানে নিষ্ক্রিয় উপাদান আছে, ফলে শরীর প্রায় 7 ঘন্টা পর্যন্ত আগুন ধরে রাখতে পারে। এই সময়ে তাপে পেশীগুলো শুকিয়ে সংকুচিত হয়ে যায় এবং অঙ্গের বিকৃতি আকার ধারন করে। হাড় পুড়ে যেতে অনেক সময় লাগে তাই শেষ পর্যন্ত পোড়া কঙ্কালটি সাধারণত শারীরিক মডেলের মত অবশিষ্ট হিসাবে থেকে যায়।
Link:
মোমবাতি কেমন করে জ্বলে?
মৌচাক থেকে মধু সরিয়ে নিলে যা অবশিষ্ট থাকে সেটাই প্যারাফিন বা মোম। মোমবাতির মুল উপাদান হল মোম যা হাইড্রোকার্বন জাতীয় পদার্থ। যা মোমবাতির জ্বালানি হিসাবে কাজ করে।
মোমবাতিতে যখন আগুন জ্বালানো হয় তখন মোম আগুনে জ্বলে না, কিন্তু এর ভিতরের সুতাটি আগুনে জ্বলে। যখন মোমবাতি জ্বলে তখন যদি আমরা সুতার নিচে খেয়াল করলে দেখবো যে, খানিকটা মোম গলে তরল হয়ে গেছে। লক্ষ্য করলে আরও দেখা যাবে যে, ঐ জায়গায় মোম গলে বাটির মতো ভিতরের দিকে ঢুকে গেছে এবং ঐ অংশের মোম তরল অবস্থায় আছে।
তরল পদার্থর মধ্যে কৈশিক আকর্ষণ দেখা যায়, ফলে তল পদার্থ নিচের দিকে টানে। মোমের ক্ষেত্রে ভিতরে মোম বিদ্যমান সুতা বেয়ে উপরের দিকে উঠে থাকে কারণ সুতোর ভিতরে অসংখ্য সরু নলের মত ছিদ্র থাকে যাকে কৈশিক নল বলে। কৈশিক আকর্ষণের ফলে তরল মোম কৈশিক নল বেয়ে একেবারে সুতোর মাথায় চলে আসে। ফলে আগুন জ্বলে। আর গরম তরল মোম পুড়ে একেবারে গ্যাস হয়ে যায় এবং এ গ্যাসই সুতোর মাথায় জ্বলে আলো দেয়৷ জ্বলার আসল অর্থ হলো বাতাস অক্সিজেনের সাথে দহন বিক্রিয়া। আবার যদি মোমবাতির কার্বনের সবটুকু অংশ পুড়ে কার্বন-দাই-অক্সাইড গ্যাস হতো তাহলে কেবল তাপ পাওয়া যেত কিন্তু আলো পাওয়া যেত না।
Link:
উপরের বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করলে এই কথা স্পষ্ট হয় যে, দহন বিক্রিয়ার ফলেই আগুনে সব কিছু পুড়ে। আর এই দহন বিক্রিয়া সংগঠিত হওয়ার জন্য প্রয়োজন অক্সিজেন, জ্বালানী ও তাপ থাকা। জ্বালানী তখন ই পুড়বে যখন বাতাসের অক্সিজেন আর তাপের উপস্থিত থাকবে। নাহলে কখনো আগুন জ্বলবে না আর আগুনে কিছু পুড়বে না।
ধন্যবাদ সবাইকে 🙂