ব্রেইনপ্রিন্ট: সাইবার সিকিউরিটির নতুন অধ্যায়

603

বিজ্ঞানের অনন্য অবদান হল আধুনিক সভ্যতা । সভ্যতা যতই এগিয়ে যাচ্ছে, বিপ্লব হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তির। তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে সাথে মানুষ হয়ে উঠছে সাইবার নির্ভর। আর এর মূলে রয়েছে, কম্পিউটার আর ইন্টারনেটের চরম পর্যায়ের অবদান।

আগেরকালে দুরদুরান্তের প্রিয়জনের খোঁজ খবর নিতে অপেক্ষার প্রহর গুনতে হত, নির্ভর করতে হত ডাক বিভাগের উপর, আর শত-সহস্র পথ পেরিয়ে, অপেক্ষার প্রহর শেষে প্রিয়জনের হাতে পৌঁছতো সেই চিঠি। আর এখন তা কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার!

মেসেজিং, ফোন করে সহজে আমাদের কাছের দুরের মানুষের খোঁজ নিতে পারি। মেসেজিং, ফোনের খরচ আবার বেশি। সেই খরচ কমাতে আবির্ভাব হল ইমেইল, ভাইবার, হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জার ইত্যাদির। যার মাধ্যমে মুহূর্তের মাঝে প্রিয় মানুষটির খবর জেনে নিতে পারি। এসব সম্ভব হয়েছে তথ্যপ্রযুক্তির উন্নতির কারনে।

আগে সাধারণত প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো সাধারণত ফাইল বা রেকর্ড করে রাখা হত ফলে তথ্য রাখার জন্য অনেক জায়গা প্রয়োজন হত এবং সময় ও নষ্ট হত। তাছাড়া দুর্যোগ বা আগুনে এইসব ফাইল সহজে নষ্ট হত, বিভিন্ন ভাবে হারিয়ে যেত নয়তো চুরি হত। তথ্যপ্রযুক্তির উন্নতির ফলে এখন সার্ভারে ডাটাবেজ আকারে সাজানো হয়। ফলে সময় ও জায়গা কম লাগে এবং চুরি বা হারিয়ে যাওয়ার ভয় কম থাকে।

এতক্ষণ যাবত সাইবার বা তথ্যপ্রযুক্তির গুণগান বললেও, এর অনেক অপকারী দিক আছে। বিভিন্ন ধরনের সাইবার ক্রিমিনাল, যারা হ্যাকার নামে পরিচিত তাঁরা বিভিন্নভাবে মানুষের কনফিডেন্সিয়াল তথ্য হাতিয়ে নিয়ে মানুষকে বিভিন্নভাবে বেকায়দা বা সমস্যাতে ফেলে। ফলে মানুষ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই তথ্যকে নিরাপত্তার জন্য বাড়ছে ইন্টারনেট সিকিউরিটি বা তথ্য নিরাপত্তার গুরুত্ব।

কিভাবে তথ্য হাতিয়ে নেয়?

তথ্য কিভাবে হাতিয়ে নেয় তা জানার আগে প্রয়োজন সাইবার কি?

একটা ছোট উদাহরণ এর মাধ্যমে বুজিয়ে দিই, ধরুন কতগুলো কম্পিউটার একসাথে মিলে একটি নেটওয়ার্ক গঠন করছে। যেখানে ডাটা বা ইনফরমেশন এক জায়গা থেকে অন্যজায়গায় আদান-প্রদান করা হয়। এই সমগ্র সিস্টেমটাই হল সাইবার। আর সিস্টেমে বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করে, তথ্য হাতিয়ে নেওয়াটাই হল হ্যাকিং। আর যারা এইসব কাজ করে তাদের বলা হয় হ্যাকার বা সাইবার ক্রিমিনাল।

 

হ্যাকিং বলতে অনেকে হয়তো ওয়েবসাইট বা ফেসবুক আইডি হ্যাকিং কে মনে করতে পারেন আসলে কিন্তু তা না। বিভিন্ন ধরনের হ্যাকিং হতে পারে। যেমনঃ

  • ইলেক্ট্রিক্যাল ডিভাইস হ্যাকিং। যেমনঃ মোবাইল, টেলিফোন, ল্যাপটপ, পার্সোনাল কম্পিউটার ইত্যাদি।
  • ওয়েব সার্ভার হ্যাকিং ইত্যাদি।
  • নেটওয়ার্ক হ্যাকিং। যেমনঃ ওয়াইফাই নেটওয়ার্ক, ওয়্যারলেস নেটওয়ার্ক, এটিএম বুথ নেটওয়ার্ক ইত্যাদি।
  • ট্র্যাকিং নেটওয়ার্ক হ্যাকিং। যেমনঃ ড্রোন ট্র্যাকিং, বিমান ট্র্যাকিং, চালকবিহীন গাড়ি ট্র্যাকিং ইত্যাদি।
  • বিভিন্ন কার্ড হ্যাকিং। যেমনঃ ক্রেডিট ও ডেবিট কার্ড ইত্যাদি।
  • বিভিন্ন একাউন্ট হ্যাকিং। যেমনঃ ইমেইল, ফেসবুক, ভাইবার, হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জার, ট্যাঙ্গো, উইচ্যাট একাউন্ট হ্যাকিং।

হ্যাকাররা প্রথমে একাউন্ট, ইলেক্ট্রিক্যাল ডিভাইস, সিস্টেম বা নেটওয়ার্কের দুর্বলতা বের করে। সেই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে করে সিস্টেমে প্রবেশ করে। সিস্টেমের তথ্যগুলো কালেক্ট করে ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয়। অনেক সময় সিস্টেম ডিজেবল করে দেয় দেয় কিংবা সিস্টেমকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়। আবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে বিশেষ করে ফেসবুকে বিভিন্ন ফানি, প্রয়োজনীয় বা আকর্ষণীয় পেজের আড়ালে বিভিন্ন ফিশিং সাইট খুলে। যা মুলত হ্যাকিং সাইট হিসাবে কাজ করে। ইউজাররা আবেগের বশবর্তী হয়ে এইসব সাইটগুলোতে ক্লিক বা হিট করে ফলে তাদের ফেসবুকের ইমেইল আইডি, পাসওয়ার্ড হ্যাকার এর কাছে চলে যায়। ফলে হ্যাকার তথ্যগুলো পেয়ে যায়।  এইভাবে তথ্যগুলো পেয়ে যাচ্ছে।

ইন্টারনেট সিকিউরিটির গুরুত্ব বাড়ছে কেন??

যতই দিন যাচ্ছে মানুষ ততই ইন্টারনেট নির্ভর হয়ে যাচ্ছে। তাই সাইবার অপরাধ, হ্যাকিংও দিনদিন বেড়ে যাচ্ছে। সহজে মানুষের কনফিডেন্সিয়াল তথ্যগুলো হাতিয়ে নিচ্ছে সাইবার ক্রিমিনাল বা হ্যাকাররা। তাই ইউজাররা বিভিন্ন প্রকার সিকিউরিটি অপশন বা সফটওয়্যার ব্যবহার করে শক্তিশালী নিরাপত্তা গড়ে তোলার করা হচ্ছে।

এখন সাধারণত দেখা যায় যে অনেক বড় পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে ইউজাররা। যাতে সহজে পাসওয়ার্ড হ্যাক করা না যায়। তাছাড়া ফিঙ্গারপ্রিন্ট, ভয়েজ রিকোগনাইজেশন, ফেইস রিকোগনাইজেশন, রেটিনা রিকোগনাইজেশন, ইউএসবি পোর্ট নাম্বার স্ক্যানিং, কিউআর কোড ইত্যাদির মাধ্যমে সিকুরিটিকে যথেষ্ট শক্তিশালী করার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু সাইবার ক্রিমিনাল বা হ্যাকাররাও থেমে নেই। তারাও নিরন্তর ভাবে নতুন নতুন পদ্ধতিতে, কিংবা বিভিন্ন টুল ব্যবহার সিকুরিটি হ্যাক বা দুর্বল করার চেষ্টা করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। যার ফলে ইন্টারনেট সিকুরিটির গুরুত্ব দিনদিন বেড়েই চলছে।

ব্রেইনপ্রিন্ট বা মস্তিষ্কের বায়োম্যাট্রিক স্ক্যানিং কি?

তথ্য নিরাপত্তা বা সাইবার সিকিউরিটির কে আরো শক্তিশালী ও গতিশীল করার জন্য সাইবার বিজ্ঞানী, স্পেশালিষ্টরা প্রতিনিয়ত নতুন কিছু উদ্ভব করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাঁর ধারাবাহিকতায় এসেছে ব্রেইনপ্রিন্ট বা মস্তিষ্কের বায়োম্যাট্রিক স্ক্যানিং। এটি একটি বহু ফ্যাক্টর বিশিষ্ট একক ধাপের পদ্ধতি। এর মাধ্যমে সহজে কোনো সিস্টেম বা একাউন্টের প্রকৃত ইউজারকে শনাক্ত করে নিরাপত্তার সাথে প্রবেশ করা সহজ হবে।

এই পদ্ধতিতে মস্তিস্কের স্ক্যানিং করার মাধ্যমে, কোনো সিস্টেম, সার্ভার ও একাউন্টের প্রকৃত ইউজাররা সাইবার বা কম্পিউটারে বা বিভিন্ন অনলাইন একাউন্ট যেমন গুগল ড্রাইভ, এভারনোট ইত্যাদি কিংবা সার্ভারে তথ্য সংরক্ষণ বা এক্সেস করা এবং তথ্যের শক্তিশালী নিরাপত্তা দিতে সম্ভব হবে। ফলে সাইবার ক্রিমিনাল বা হ্যাকারদের পক্ষে অন্য ইউজারের একাউন্টে প্রবেশ বা কোন সার্ভারে সাইবার আক্রমন করা অতিমাত্রায় কঠিন হবে বলে সাইবার বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছেন।

ব্রেইনপ্রিন্ট কিভাবে কাজ করে?

এই পৃথিবীতে প্রত্যেকটি মানুষের ফিঙ্গার প্রিন্ট, চোখের মনি, DNA এর মত মস্তিস্কের কোষগুলোও একে অন্যের থেকে অালাদা। এই মস্তিস্কের কোষগুলোর অন্যান্য অঙ্গের মত নির্দিষ্ট প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করে থাকে। যা প্রকৃতপক্ষে স্বতন্ত্র বা ইউনিক।

সাইবার বিজ্ঞানীরা ব্রেইনপ্রিন্ট গবেষণাটি করার জন্য বেশ কিছু সংখ্যক মানুষকে পরীক্ষার জন্য বেছে নেন। তারপর তাদের উপর ইলেক্ট্রো-এনসেফ্লো-গ্রাম (Electro-Encephalo-Gram=EEG) পরীক্ষা করা হয়। এতে তাদের মস্তিস্কের প্রতিক্রিয়াগুলোকে বৈদ্যুতিক কার্যকলাপ হিসাবে নিয়ে রেকর্ড করা হয়। যা সংক্ষেপে ইইজি নামে পরিচিত।

গবেষণায় দেখা যায়, মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ থেকে প্রাপ্ত প্রতিক্রিয়াগুলো প্রতিটি ব্যক্তির জন্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাদের প্রতিক্রিয়াগুলোর বৈদ্যুতিক কার্যকলাপকে কম্পিউটার দিয়ে পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষায় দেখা যায়, কম্পিউটার নির্ভুলভাবে ৯৪ শতাংশ ব্যক্তিকে সনাক্ত করতে সক্ষম হয়। গবেষণায় আরও দেখা যায় যে, এই প্রতিক্রিয়াগুলো দীর্ঘস্থায়ী এবং ৬ মাস পরেও নির্ভুল সনাক্তকরনের হার একই।  বিজ্ঞানী ও স্পেশালিষ্টরা সনাক্তকরন নির্ভুলতাকে ১০০% এ করার জন্য জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

কম্পিউটার, বিভিন্ন একাউন্ট এবং সার্ভারে প্রবেশের ক্ষেত্রে, EEG পরীক্ষার মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যগুলোর সাথে বর্তমান প্রাপ্ত তথ্য সাথে ম্যাচিং বা মিল করানো হয়। তাতে কেবল তথ্যগুলো মিল হলেই এক্সেস করতে সক্ষম হবে। এতে তথ্য হ্যাক করা কঠিন হয়ে পড়বে এবং দুর্বোধ্য পাসওয়ার্ড মনে রাখার মত কষ্ট করা লাগবে না। তথ্যগুলো নিরাপত্তার সাথে রাখা সহজ হবে 😀

আশা করা যায়, ব্রেইন প্রিন্ট বা মস্তিকের বায়োমেট্রিক স্ক্যানিং সাইবার জগতে নতুন দিগন্ত বয়ে আনতে সহায়ক হবে।

ধন্যবাদ সবাইকে। 🙂

তথ্যসুত্রঃ

 

লিখাটি নিয়ে আপনার অভিমত কি?