সর্বকালের সর্বসেরা পাঁচ সায়েন্স ফিকশন লেখক

সেরা সায়েন্স ফিকশন লেখক

সর্বকালের সর্বসেরা কথাটি হয়ত ঠিক না। আবার বেঠিকও না। কে প্রথম, কে দ্বিতীয় এই নিয়ে অনেকেরই আপত্তি থাকতে পারে। তবে নিশ্চিত সর্বকালের সর্বসেরা সায়েন্স ফিকশন লেখকদের ছোট তালিকায় এদের নামই থাকবে। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করে আইজ্যাক আজিমভই সেরা। তথাপি ওয়েবসাইট ঘেঁটে বের করা এ তালিকায় অনেকেরই মতামতের প্রতিফলন ঘটেছে। যাহোক, তাদের জীবনের যত অর্জন সব কিছু নিয়ে লিখা তো আর সম্ভব না। এদের প্রায় সবারই কল্প-বিজ্ঞান লেখার পাশাপাশি বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান আছে। তথাপি এখানে একদম সংক্ষিপ্তাকারে তাদের জীবনের কিছু উল্লেখযোগ্য দিকগুলি তুলে ধরার চেষ্টা করে হয়েছে...

এইচ. জি. ওয়েলস (২১শে সেপ্টেম্বর ১৮৬৬ – ১৩ আগস্ট ১৯৪৬):

হারবার্ট জর্জ ওয়েলস (Herbert George Wells)  বা সংক্ষেপে যিনি এইচ.জি.ওয়েলস নামেই বেশী পরিচিত। তিনি যে শুধু সায়েন্স ফিকশন লেখক ছিলেন তা নয়, বরং রাজনীতি, ইতিহাস এমনকি টেক্সট বই এবং যুদ্ধের নিয়ম সংক্রান্ত বিভিন্ন বইও লিখেছেন। কিন্তু সাই-ফাই(Sci-fi) লেখক হিসেবেই তিনি বেশী সুখ্যাতি অর্জন করেন। তাঁকে জুলভার্ন এবং হিউগো জার্নসবার্গের সাথে একত্রে বলা হয় “সায়েন্স ফিকশন এর জনক”।

এইচ. জি. ওয়েলস
এইচ. জি. ওয়েলস

 নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে ওয়েলসের ছোটবেলা কাটে বিভিন্ন উত্থান-পতনের মাঝ দিয়ে। তার জীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনাটি ঘটে ১৮৭৪ সালে। যার ফলস্বরূপ ভাঙ্গা পা নিয়ে তাকে বেশ কিছুদিন বিছানায় শুয়ে থাকতে হয়। এসময় তাঁর বাবা স্থানীয় লাইব্রেরী থেকে বিভিন্ন বই এনে দিতেন, যা তাকে প্রথম বাইরের বিশ্ব সম্বন্ধে আগ্রহী করে তুলে।

ওয়েলসের প্রথম বেস্টসেলার হল “অ্যান্টিসিপেশনস অফ দি রি-একশন অফ মেকানিক্যাল এন্ড সাইন্টিফিক প্রগ্রেস আপন হিউম্যান লাইফ এন্ড থট(১৯০১)” যেটা সর্বপ্রথম একটি ম্যাগাজিনে “অ্যান এক্সপেরিমেন্ট ইন প্রফেসি” শিরোনামে ধারাবাহিকাকারে বের হয়। তার উল্লেখযোগ্য কিছু বই হল “দি টাইম মেশিন(১৮৯৫)”, ”দি আইল্যান্ড অফ ডক্টর মোরি(১৮৯৬)”, “দি ইনভিজিবল ম্যান”(১৮৯৭), “দি ওয়ার অফ দি ওয়ার্ল্ডস(১৮৯৮)”, “দি ফার্স্ট ম্যান ইন দি মুনস” ইত্যাদি। এছাড়াও তিনি অসংখ্য ছোট গল্প ও নভেলের লেখক যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল “দি কান্ট্রি অফ দি ব্লাইন্ড”। বিখ্যাত মুভি সিরিজ ‘স্টার ট্রেক’-র এপিসোড ‘উইঙ্ক অফ অ্যান আই’ তার ছোট গল্প “দি নিউ এক্সিলারেটর” থেকে অনুপ্রাণিত।

ওয়েলস ১৯৪৬ সালে লন্ডনে মারা যান।

জুলভার্ন
জুলভার্ন

জুলভার্ন (৮ ফেব্রুয়ারী ১৮২৮ – ২৪ মার্চ ১৯০৫):

জুলস গ্যাব্রিয়েল ভার্ণ (Jules Gabriel Verne) একজন ফরাসী লেখক যাকে সায়েন্স ফিকশন ধারার পথিকৃত বলা হয়ে থাকে।

জুলসের ছোটবেলা কাটে ‘ন্যান্তেস’ নামক ফ্রান্সের একটি বন্দর নগরীতে। তিনি ও তার ভাই পল প্রায়ই নৌকা ভাড়া করে বেড়াতেনএসময় তিনি দেখতেন কত দেশের কত জাহাজ বন্দর দিয়ে অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি দিচ্ছে, যা তার মনে দোলা দেয়। তাই ছোটবেলা থেকেই ভ্রমণ এবং আবিষ্কারের প্রতি অন্যরকম টান ছিল। এর প্রতিফলন পাওয়া যায় তার লেখাতেই।

তার লেখা থেকে সেরা হিসেবে বিবেচ্য হয় “টুয়েন্টি থাউজেন্ড লীগস আন্ডার দ্য সী(১৮৭০)”, “আ জার্নি টু দ্য সেটার অফ দ্য আর্থ(১৮৬৪)”, “অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ডস ইন এইট্টি ডেজ(১৮৭৩)”।

আইজ্যাক আজিমভ (২ জানুয়ারি ১৯২০ – ৬ এপ্রিল ১৯৯২):

সাবেক ‘রাশিয়ান সোভিয়েত ফেডারেটিভ সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক’ এর ‘পেত্রভিচি’-তে জন্ম নেয়া আজিমভের জন্মসূত্রে নাম আইজ্যাক ইউডোভিচ অজিমভ (Isaac Yudovich Ozimov)তিনি ছিলেন একজন আমেরিকান লেখক এবং বোস্টন ইউনিভার্সিটির ‘বায়ো-কেমিস্ট্রি’-র প্রফেসর। আজিমভকে বিশুদ্ধ সায়েন্স ফিকশন এর মাস্টার বলা হয়ে থাকে। তাঁর লেখনীর প্রতিটি অংশে কল্প-বিজ্ঞানের প্রতিটি চরিত্র ফুটে উঠে, যা তাঁকে অনবদ্য করে তুলে। আজিমভকে সর্বকালের সেরা প্রোফাইলিক লেখক বলা হয়ে থাকে। বিখ্যাত “বিগ থ্রী”-তে “আর্থার সি ক্লার্ক” ও “রবার্ট এ. হেইনলেন”-র সাথে তিনিও পরিগণিত হন।

আইজ্যাক আজিমভ
আইজ্যাক আজিমভ

তার তিন বছর বয়সে তার পরিবার আমেরিকা পাড়ি জমায়। আজিমভ ছোটবেলা থেকেই সায়েন্স ফিকশন পাল্প ম্যাগাজিন পড়তেন। তার বাবা যদিও একে আজে-বাজে বলে তার জন্য পড়া নিষিদ্ধ করেন তথাপি শুধুমাত্র শিরোনামে ‘সাইন্স’ লেখা থাকার কারণে তারপরও তিনি তা পড়তেন। ১৮ বছর বয়সে তিনি প্রথম লিখতে শুরু করেন।

আজিমভের লেখার ইতিহাস অনেক সমৃদ্ধ। তার লেখা প্রথম সায়েন্স ফিকশন হল “কসমিক কর্কস্ক্রু”। তার সবচেয়ে বিখ্যাত লেখা হল “ফাউন্ডেশন” সিরিজ। এছাড়া তার অন্যান্য উল্লেখযোগ্য সিরিজ হল “রোবট” সিরিজ ও “গ্যালাক্টিক এম্পায়ার” সিরিজ। এছাড়া তিনি অনেক ছোটগল্প লিখেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল “নাইটফল”, যেটা ১৯৬৪ সালে ‘সায়েন্স ফিকশন রাইটারস অন আমেরিকা’ কর্তৃক সর্বকালের সেরা ছোট সায়েন্স ফিকশন গল্প হিসেবে নির্বাচিত হয়। ‘উইল স্মিথ’ অভিনীত বিখ্যাত হলিউডি মুভি “আই-রোবট(২০০৪)”-র গল্প তার রোবট সিরিজের একটি গল্প অনুসারে তৈরী।

১৯৬০ সালে বিখ্যাত মুভি সিরিজ “স্টার ট্রেক”-র শুরু থেকে এর নির্মাতা ‘জিনি রোডেনবেরী’-র সাথে তার একটি সম্পর্ক গড়ে উঠে এবং তিনি “স্টার ট্রেক” প্রজেক্টের বিজ্ঞানভিত্তিক নিঁখুততার জন্য উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেন।

আর্থার সি. ক্লার্ক (১৬ ডিসেম্বর ১৯১৭ – ১৯ মার্চ ২০০৮):

স্যার আর্থার চার্লস ক্লার্ক (Sir Arthur Charles Clarke) হলেন একাধারে একজন সায়েন্স ফিকশন লেখক, আবিষ্কারক এবং ভবিষ্যত স্বপ্নদ্রষ্টা। তিনি বিখ্যাত “বিগ থ্রী”-র অন্যতম।

ইংল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করা আর্থার ছোটবেলা থেকে মহাকাশের ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন। তিনি পুরনো আমেরিকান সায়েন্স ফিকশন পাল্প ম্যাগাজিন পড়তেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি রয়েল এয়ার ফোর্সের রাডার বিশেষজ্ঞ হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৪৫ সালে তার প্রস্তাবিত রাডার যোগাযোগ ব্যবস্থা পরবর্তীতে ১৯৬৩ সালে ‘ফ্রাঙ্কলিন ইন্সটিটিউট স্টুয়ার্ট ব্যালেন্টাইন’ কতৃক স্বর্ণপদক প্রাপ্ত হয়।

আর্থার সি. ক্লার্ক
আর্থার সি. ক্লার্ক

ক্লার্কের বেশ কিছু লেখা ফ্যানজাইনস-এ প্রকাশিত হয়। বাণিজ্যিকভাবে তার প্রথম প্রকাশ “অ্যাজটাইন্ডিং সায়েন্স ফিকশন(১৯৪৬)”। ধীরে ধীরে প্রকাশিত হয় “লুপহোল” ও “রেসকিউ পার্টি”। লেখার পাশাপাশি তিনি “সাইন্স অ্যাবস্ট্রাক্ট”-র সহকারী সম্পাদক হিসেবেও কাজ করেন। ১৯৪৮ সালে বিবিসি প্রতিযোগিতার জন্য লিখেন “দ্য সেন্টিনেল”। লেখাটি যদিও বাতিল হয়ে যায় তথাপি এই লেখাই তার ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ১৯৭২ সালে তার পুরস্কার জেতা নভেল “রেন্দেভাজ(Rendezvous) উইথ রামা” প্রকাশিত হয়। ২০০১ সালে তিনি লিখেন তার বিখ্যাত ছোটগল্প “দ্য স্পেস ওডেসী”।

১৯৯৮ সালে ক্লার্ক রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ কর্তৃক নাইট উপাধি পান। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি শ্রীলংকায় কাটান। তার স্কুবা ড্রাইভিংযের নেশা ছিল। এভাবেই সাগরের তলদেশে তিনি আবিষ্কার করেন প্রাচীন কোনেশ্বরম মন্দির এবং ত্রিংকোমালে। 

রবার্ট এ. হেইনলেন (৭ জুলাই ১৯০৭ – ৮ই মে ১৯৮৮):

রবার্ট অ্যানসন হেইনলেন (Robert Anson Heinlein) একজন আমেরিকান সায়েন্স ফিকশন লেখক যাকে বলা হয়ে থাকে “সায়েন্স ফিকশন লেখকদের ডীন”। তিনি এধারার অন্যতম প্রভাবশালী ও বিতর্কিত লেখক। বহু বছর ধরে তিনি বেস্ট সেলার লেখক হিসেবে পরিচিত ছিলেন“বিগ থ্রী”-র অন্যতম এই লেখক ছোট সাইন্স ফিকশনের জন্যেও বিখ্যাত।

মিসৌরীতে জন্ম নেয়া হেইন্সলেন তার ছোটবেলা মিসৌরী, ক্যানসাসে কাটান। এসব এলাকার পরিবেশ ও অভিজ্ঞতার প্রতিফলন দেখা যায় তার লেখনীতে। তার অভিজ্ঞতা তিনি তুলে ধরেন “টাইম এনাফ ফর লাভ” ও “টু সেইল বেয়ন্ড দ্য সানসেট”-এ।

রবার্ট এ. হেইনলেন
রবার্ট এ. হেইনলেন

তার প্রথম প্রকাশিত গল্প “লাইফ লাইন”। ১৯৬১ সালে প্রকাশিত তার নভেল “স্ট্রেঞ্জার ইন এ স্ট্রেঞ্জ ল্যান্ড” অনেকের দৃষ্টিতে মাস্টারপিসের মর্যাদা লাভ করে। এছাড়া সর্বকালের সেরা বিখ্যাত সাইন্স ফিকশনের তালিকাতেও এর নাম প্রথম সারিতে। ১৯৬৬ সালে লিখেন “দ্য মুন ইজ আ হার্শ মিস্ট্রেস”। এছাড়া তিনি “স্টারশীপ ট্রুপারস” নামে একটি মিলিটারী সাইন্স ফিকশন লিখেন যা “হিউগো অ্যাওয়ার্ডস” লাভ করে এবং যার থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে পরবর্তীতে ফিল্ম ও গেমস নির্মিত হয়। ছোটগল্প হিসেবে তার উল্লেখযোগ্য লেখা হল “দ্য গ্রীণ হিলস অব আর্থ”।

তিনি হিউগো অ্যাওয়ার্ডস, গ্র্যান্ড মাস্টার অ্যাওয়ার্ডসহ অনেক পুরস্কারে ভূষিত হন

(তথ্যসূত্রঃ ইন্টারনেট)

-------------------------------------------------------------------------

লেখকঃ নাবিল আহমেদ, নোবিপ্রবি

[ লেখাটি বিজ্ঞান বাংলা প্রকাশিত গ্যালাক্টিকা ম্যাগাজিনের জানুয়ারি সংখ্যা,২০১৩ তে প্রকাশিত হয়েছে ]

 

লিখাটি নিয়ে আপনার অভিমত কি?