যদি বলা হয় বিশ্বের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত ও সম্মানজনক পুরষ্কার কোনটি? তাহলে নিঃসন্দেহে বেশিরভাগ লোকের কাছ থেকে উত্তর আসবে নোবেল পুরষ্কার (Nobel prize)। সুইডিশ বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেলের নামানুসারে এই পুরষ্কারের নামকরণ। তিনি তার উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পত্তি আর নিজের আবিষ্কার ডিনামাইট এর প্যাটেন্ট বিক্রি করে পাওয়া বিপুল পরিমান অর্থ তার মৃত্যুর আগে একটি উইল করে রেখে যান। উইল অনুসারে এই পুরষ্কার ও বিপুল পরিমান অর্থ দেওয়া হয়।মোট ছয়টি বিভাগে এ পুরষ্কার দেওয়া হয়,তার মধ্যে বিজ্ঞানের তিনটি। আজকে আমরা ২০১২ সালের রসায়নে নোবেল প্রাপ্তি নিয়ে আলোচনা করব।
এ বছর রসায়নে নোবেল পান যৌথভাবে বিজ্ঞানী রবার্ট লেফকোভিৎজ ও ব্রায়ান কোবলিকা। প্রথমজন পোল্যান্ড এর বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক। পড়াশুনা করেছেন কলোম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসা বিজ্ঞান ও শল্য চিকিৎসার উপর। অপরজন ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিকিৎসা বিজ্ঞানে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন। বর্তমানে স্ট্যানফোর্ডে মলিকিউলার ও সেলুলার ফিজিওলজি বিভাগে অধ্যাপনা করছেন। এদের মধ্যে মূলত ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক।
তাদের গবেষণার বিষয় ছিল জি-প্রোটিন কাপল রিসেপ্টর এর কাজের ব্যাখ্যা প্রদান করা। জি-প্রোটিন কাপল রিসেপ্টর সংক্ষেপে জিপিসিআর (GPCR) হল আমাদের রোগ নিরাময়ের জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। ব্যাপারটা একটু ব্যাখ্যা করা যাক। আমরা যখন ত্বকে ব্যাথা অনুভব করি বা শরীরের কোথাও মশার কামড় অনুভব করি তখন সেটা আমরা বুঝতে পারি। কারন ত্বকের নিচে কিছু রিসেপ্টর আছে যেগুলো ঐ খবরগুলো গ্রহন করে। আর সেনসরি নার্ভ বা সেনসরি স্নায়ু গুলো এই খবরটা মস্তিস্কে পৌঁছে দেয়। আর তারপর মস্তিক তখন সেটাকে বিশ্লেষণ করে, এর কি করতে হবে। এরপর মোটর বা আজ্ঞাবাহী স্নায়ু এই খবরটা যেঁখানে অনুভূতিটা হয়েছিল সেখানে পাঠিয়ে দেয়। কেবলমাত্র তখনি আমরা বুঝতে পারি যে এখানে ব্যাথা পেয়েছি, বা আমাকে মশা কামড়িয়েছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে এই রিসেপ্টর গুলো কতটা গুরুত্বপূর্ণ। এই রিসেপ্টর গুলো শুধু ত্বকে না , সারা দেহেই এমনকি দেহের ভিতরের প্রত্যেকটা কোষেই আছে। এদের কাজ হল রাসায়নিক সংকেত গ্রহন করে জায়গামত দিয়ে দেয়া।
যেকোনো জীবের জীবন আসলে কিছু জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়ার সমষ্টি। তাই বেঁচে থাকার জন্য এই রিসেপ্টরগুলোর কার্যকলাপও খুবই অপরিহার্য একটি ব্যাপার। রিসেপ্টর গুলোকে মোট চার ভাগে ভাগ করা যায়ঃ- আয়ন চ্যানেল যুক্ত রিসেপ্টর, এনজাইম লিঙ্কড রিসেপ্টর, জি-প্রোটিন কাপল রিসেপ্টর আর নিউক্লিয়ার রিসেপ্টর।
আয়ন চ্যানেল যুক্ত রিসেপ্টর এর কাজ হল নিউরন বা স্নায়ু কলাকে অনবরত সংকেত প্রদান করা। এনজাইম লিঙ্কড রিসেপ্টর মুলত কোষের ভিতরের ফসফেটজাত যৌগ তৈরির কাজে নিয়োজিত থাকে। জি-প্রোটিন কাপল রিসেপ্টর হল সেল মেমব্রেন বা কোষ ঝিল্লীর গাঠনিক উপাদান। এরা রাসায়নিক ভাবে প্রোটিন ইন নেচার আর কোষের আন্ত-ঝিল্লীয় হেলিক্সকে ধারন করে। তবে আসল ব্যাপারটা হল, এই বিশেষ ধরনের রিসেপ্টরগুলো চিকিৎসা বিজ্ঞানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। যাই হোক, এই রিসেপ্টরগুলো শুধুমাত্র ইউকারিওটিক কোষে পাওয়া যায়। তার মানে এই রিসেপ্টরগুলো উন্নত প্রাণিদের বৈশিষ্ট্য। এগুলো কিছু কিছু বিশেষ ক্ষমতাবান প্রোটিন অনু ধারন করে, যেগুলো কোষের অনুগুলোর সংকেত আনা নেওয়ার কাজ করে। এই দুই বিজ্ঞানীর গবেষণা এজন্যই গুরুত্বপূর্ণ যে বেশিরভাগ রোগের প্রতিষেধক ঔষধের কার্যকারীতা জি-প্রোটিন কাপল রিসেপ্টর এর কার্যকারিতার উপর নির্ভর করে। আধুনিক ঔষধের প্রায় ৪০% তৈরি করা হয় এই রিসেপ্টর গুলোর উপর কাজ করার জন্য। প্রত্যেকটি রোগের যেমন একটা কারন থাকে তেমনি সেই রোগটা প্রকাশ পাবার জন্যও দেহের কিছু পরিবর্তন হয়। আর এই প্রক্রিয়ার কিছু গুরুত্বপূর্ণ অংশ জুড়ে আছে এই রিসেপ্টরগুলোর ভুমিকা। এই রিসেপ্টর গুলোর কাজের গতি-প্রকৃতির ব্যাখ্যা দেবার জন্যই এদের এই বিশেষ সম্মান দেওয়া হয়। লেফকোভিৎজ ১৯৬৮ সালে কোষের রিসেপ্টরের খোঁজ করার জন্য এতে তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ ব্যবহার করেন। তিনি বেশ কয়েকটি রিসেপ্টর খুজে পান। তার মধ্যে একটি হল বিটা এড্রিনারজিক রিসেপ্টর (এটি এক ধরনের জি-প্রোটিন কাপল রিসেপ্টর )। এটি এড্রিনালিন হরমোন গ্রহণের সাথে জরিত। এড্রিনালিন হরমন ক্ষরণ হলে ও রিসেপ্টর দ্বারা গৃহীত হলে আমাদের উত্তেজনা বেড়ে যায় ও রক্তচাপ বেড়ে যায়। যার ফলে এই রিসেপ্টরটি বন্ধ করার জন্য কাজ করে, অনেক সফল রক্তচাপ নিয়ন্ত্রনের ঔষধ বের করা গেছে। যেমনঃ- প্রপানলল ও এটিনলল এই রকম বিটা এড্রিনারজিক রিসেপ্টর বন্ধকারী ঔষধ। মানুষের জিনোম থেকে বিটা এড্রিনারজিক রিসেপ্টর আলাদা করতে সক্ষম হন কোবলিকা। আর এর কাজের ও ব্যাখ্যাও দান করেন তিনি। কোবলিকা আর তার গবেষক দল ২০১১ সালের দিকে এসব রিসেপ্টরের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সময়ের ছবি তুলতে সক্ষম হন। বিশেষ করে, যখন এরা সেকেন্ডের কয়েক ভাগের এক ভাগ সময়ের মধ্যে হরমোনের সাথে যুক্ত হয়ে রাসায়নিক সংকেত প্রদান করে। এসব ছবি চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতি অনেক ত্বরান্বিত করবে বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানী মহল।
--------------------------------------------------------------------------
[ লেখাটি বিজ্ঞান বাংলা প্রকাশিত গ্যালাক্টিকা ম্যাগাজিনের জানুয়ারি সংখ্যা,২০১৩ তে প্রকাশিত ]